বাংলার লেখক
-অঞ্জনা গোড়িয়া
হাত তালি দিতে দিতে ঘরে প্রবেশ করল, এক রমনী। লেখক তখন লেখার নেশায় ডুবে আছে।
চোখের সামনে সরস্বতী মূর্তি। মোমবাতির শিখায় লেখকের কলম জ্বলে উঠছে। ঘরময় ছেঁড়া কাগজের টুকরো। ভাবনায় স্বপ্নে ডুবে আছে বাংলার এক লেখক।
– বাঃ সাবাস! খুব বিখ্যাত হয়েছ। বড় লেখক হতে চলেছো। খুব ভালো। তুমি মানুষের কথা লিখছো। জীবনের কথা লিখছো। সমস্ত জীব জড় জগতের বেদনা, যন্ত্রণা কষ্টের কথা লিখছো। কোনো দিন আমার কথা লিখেছ লেখক? আমার জীবনটা কেমন কাটছে ভেবেছো কোনো দিন? কত রাত বিনিদ্রায় কাটে? যাচাই করেছ কোনো দিন? সবার কষ্ট অনুভব করো। শুধু বোঝো না আমার কষ্ট। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত দু’টো নয়ন দরজা বন্ধ করে দেয়। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসিটুকু মিলিয়ে যায়। শরীর অবশ হয়ে আসে। হৃদয় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তবু আসে না আমার প্রিয়, আমার আদরের লেখক।
– কে গো তুমি? এমন করে বলো? কি কষ্ট তোমার? বলো বলো, সব লিখবো আমার সাহিত্যে। এটাই আমার কাজ গো।
– আমার কথা লিখবে? তাহলে যে তুমি সমাজে ছোট হয়ে যাবে। আমার জীবন যে তোমাকে ঘিরে।
আমার একাকীত্ব থাকার অভ্যাসটা জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। আর আমাকে নিয়ে ভাবি না লেখক।
লেখক এতোক্ষণ শুনছিল এক নারী কন্ঠীর যন্ত্রণার কথা। বোঝার চেষ্টা করছিল, কে এই রমনী যার মনে এত বেদনা? আমি তাকেই চিনি না?
– কে তুমি? বলো কি তোমার পরিচয়?
হা হা হা করে হেসে উঠল রমনী।
আলো আঁধারী আবছা আলোয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সারা ঘর। আমায় চিনতে পারলে না লেখক? কেমন সাহিত্যিক হয়েছো? তুমি ঘরকে কাঁদিয়ে পরের কষ্ট অনুভব করো। বিছানায় একাকী শয্যায় তোমার খোঁজ করি। আসো নি তুমি ঘুম পাড়িয়ে দিতে। চোখের জলে বালিশ ভেজে, তবু তোমার মন ভেজে না। আমি তোমার প্রিয়া হতে পারিনি। হয়েছি রাঁধুনি। হয়েছি তোমার সন্তানের মা। হয়েছি তোমার সংসারের গৃহিনী। তোমার অগ্নিসাক্ষী করা বউ লিপি।
– লিপি, তুমি একি বলছ? তুমি এসেছ আমার ঘরে। তুমি আমার শক্তি। তুমি আমার প্রেরণা, আমার ভালোবাসা। তুমি না পাশে থাকলে কি করে লিখি বলো? আমাকে যে শেষ করতেই হবে আমার দশ দশটি উপন্যাস। বড়ো গল্প। অনুগল্প। আর ও অনেক কিছু বাকি এখনো। এমন করে বিদ্রোহ করো না তুমি। আমি যে হেরে যাবো। সময় বড়ো কম লিপি। আমাকে শেষ করতে দাও আমার সাহিত্য।
তাই তো আমি তোমার ঘর সংসারের পাহারাদার। তোমার সন্তানের জননী। কত সৌভাগ্য আমার। কত রাত কাছে পাই নি তোমায়, মনে রেখেছো লেখক। সে সব না হয় বাদই দিলাম, কি করে সংসার চলছে, তার খোঁজ রেখেছো কোনো দিন? পাতার পর পাতা সাজিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করছো। অনেক নাম ডাক হবে, খেতাব পাবে, সাহিত্য সম্মানে সম্মানিত হবে। একদিন জাতীয় পুরস্কারও পাবে। সবাই তোমাকে চিনবে। চিনবে না শুধু তোমার প্রেয়সীকে। যে তোমার সংসার সাজিয়ে রেখেছে।
জানো ছেলেটা দু’দিন ধরে জ্বরে কাবু। তোমার মায়ের বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। আর তোমার সাধের ফুলের বাগানটায় ঘাসে ভর্তি হয়েছিল। আমি সব পরিস্কার করে জল দিয়েছি। আবার ফুলে গেছে। তুমি একবারও ফিরে তাকাও নি। আদরের টিয়া কেমন খোকার নাম ধরে বুলি বলে৷ শুনেছ কোনো দিন?
দু’মাসের মাস্টারের মাইনে বাকি। দুধের দাম দিতে পারি নি বলে, আর দেবে না বলেছে। মুদিখানা দোকানে দু’মাস বাকি। আর বাকিতে মাল দেবে না। ব্লাউজটা কবে ছিঁড়ে গিয়েছে? খেয়াল করো নি। শাড়িটা মলিন। চোখেও পরেনি তোমার। সবার দিকে নজর তোমার। শুধু আমি নজরে পড়ি না।
কত রাত খাবার ঢাকা পড়ে থাকে। খেতে আসো না। স্নান খাওয়া ঘুম কিছুই টাইমে করো না।
এত লিখে কি পাও বলো? দু’টো টাকা রোজকার হয়? বলো, কিছু পাও? কেউ খোঁজ রাখে না, কি করে তোমার সংসার চলছে? এবার একটু নিজের দিকে তাকাও। চেহারার কি হাল হয়েছে দেখো? রাত জেগে জেগে চোখের কোণে কালি। মুখ শুকিয়ে গেছে। কেউ তোমার জন্য ভাবে না। কি হবে লিখে? এত রাত জেগো না। ছেলে সংসার যে ভেসে যায়।
বাংলার লেখক, যিনি সবার কথা লেখে। মানুষের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাসাহিত্যকে সম্বৃদ্ধ করে। তারজন্য সমাজ -সরকার কি ভেবেছে? ফিরে এসো আবার সংসারে? আমি যে তোমার ভালোবাসা।
লেখক সব শুনল। তারপর বলল, তুমি কি চাও লিপি? সাহিত্য ছেড়ে দেব? তাহলে আমিও যে আর বাঁঁচব না। কিছু পাবার আশায় এত লিখি না গো। ভালোবেসে লিখি। আমার সৃষ্টি হারিয়ে গেলে আমিও হারিয়ে যাবো। বেশ তুমি যখন চাও, তাই তাই হোক। তবে এই উপন্যাসটা শেষ করতে দাও। একজন প্রকাশক বলেছে উপন্যাসটা বিক্রি হলে বেশ কিছু টাকা পাবো। আর অভাব থাকবে না। এবার যাও লিপি। আমাকে শেষ করতে দাও উপন্যাসটা। ছেলেকে বলো, কাল রাতে ঠিক আসবে তোর বাবা। মাকে বলো, বাতের ওষুধ কাল ঠিক এনে দেব। টিয়ার জন্য ছোলা আনব। এই উপন্যাসটা একবার বের হতে দাও। প্রচুর সুনাম পাবো দেখো তুমি। আর পুরস্কারের টাকা, বই বিক্রির টাকায় সব অভাব মিটিয়ে দেব। আর কটা দিন সময় দাও সোনা।
আবার ফিরে আসব তোমার কাছে। ফিরে আসব ছেলের কাছে। আমায় শুধু রাতটা দাও। তোমার জন্য আমার সারা জীবনের সাধনা সার্থক। আমায় শুধু রাতটা দাও। একটু লিখতে দাও। একটু ভাবতে দাও। ভালোবাসতে দাও আমার লেখাকে।
হঠাৎ কারোর কন্ঠস্বর ভেসে এলো। কি গো এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছ। ওঠো কত বেলা হলো দেখেছ? বাজার যেতে হবে তো।
চোখটা হালকা খুলে দেখে, দাঁড়িয়ে আছে তার লিপি। সেই চোখ সেই মুখ। শুধু মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। মৃদু হাসির রেখা।
আমি কি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম? কাল রাতে এসে কে এসেছিল?
লিপিকে প্রশ্ন করল, কাল রাতে তুমি এসেছিলে আমার ঘরে? খাবার নিয়ে।
কি যে বলো, তুমিই তো বারণ করো, যখন তখন ঘরে না আসতে। তোমার লেখার ক্ষতি হয়। একদিন খাবার নিয়ে এসেছিলাম বলে খুব বিরক্ত হয়েছিলে। আর আসি না তাই।
লেখক, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, লিপির দিকে।
তোমার খুব কষ্ট না? আমি সময় দিতে পারি না। সংসার দেখতে পারি না। একা হাতে সব সামলে রেখেছ।
লিপি, খিলখিল করে হেসে বলল, কেন গো আজ এমন করে বলছো?
তোমার লেখার জন্যই তোমাকে ভালোবেসেছি। আমি ঠিক সামলে নেব সব। এক মনে লিখে যাও তুমি। সব সময় তোমার পাশে আছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না। উপন্যাসটা শেষ করতেই হবে। তারপর আমাকে পড়িও। তুমি আমার অহংকার। আমার হৃদয় দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তোমার পাশে থাকব। তুমি হবে বাংলার সেরা লেখক।